Uncategorized

সেইসব সাজসজ্জা এবং ফুটন্ত গোলাপ

সবসময়ই বলে এসেছি আমি সব কিছুই খেয়াল করি অনেক নিখুঁতভাবে। ছোট বয়সেই দেখেছি মা খালাদের রুপচর্চা। মাজা ছাপানো একঢাল চুলে তারা সরিষার খৈল মেখে রোদে বসতেন। তারপর রিঠার পানিতে চুল শ্যাম্পু করতেন। রিঠাই শ্যাম্পু! আবার পুকুরের তলদেশে পাওয়া যেতো সাজিমাটি। সেই মাটি ডুব দিয়ে কাজের লোক দলা দলা তুলে আনতো। সেটা দিয়েও শ্যাম্পু করা হত। গোসলে থাকতো লাক্স, কসকো ইত্যাদি সাবান। সাবান বোধহয় যার যার আলাদা থাকতো। যার যার গামছা যার যার সাবান সাজিমাটি রিঠার জল মগ ঝামাইট এবং ধুন্দুল এর খোসা ( কাপড়ের মুড়িওয়ালা) নিয়ে পুকুরপাড় বসতেন এবং অবশ্যই অনেক সময় নিয়ে তারা যত্ন করে সৌন্দর্য গোসল করতেন। আমাদের নানীবুজির একটা পুরনো কাজের লোক ছিলো সে খুব কালো ছিলো। সে এগুলো সাজিমাটিমুটি বিশ্বাস করতো না। তার যত বিশ্বাস সাবানের উপর।

 গোসলের সময় সাবান মেখে সাবানের ফেনায়িত ধলা হয়ে যেতো এবং যেইনা বদনা ঘটি দিয় গায়ে পানি ঢালতো সঙ্গে সঙ্গে আগের রং বের হতো। ও যতই দুঃখ পেতো খালাম্মাদের ততই হাসি পেতো আর ও আরো রেগেমেগে আবারো সাবানের ফেনায়িত সাদা হওয়ার প্রচেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়তো। এই কথা মানে হাসাহাসি ফাঁস হওয়ায় পর নানীবুজি খুব রেগে গেলেন। হাসাহাসি ওখানেই বন্ধ হল। হাহাহাহাহা। আমার ফুপুদের খুব কমই রুপচর্চা করতে দেখেছি। মা কাচাঁ হলুদ কাঁচা দুধ মাখতেন। তিব্বত ক্রীম স্নো ছাড়াও পণ্ডস ও ছিল তাদের বিশেষ ভালবাসা। শিশুমালতি নামে মিষ্টি গন্ধের একটা পমেটম ছিল, অপূর্ব। এছাড়া আব্বা আম্মাকে নিয়মিত কান্তা সেন্ট (পারফিউম) কিনে দিতেন। আজন্ম কাল ধরেই এই সুবাস আমি খুঁজে বেড়াই। আম্মাকে আরোও দেখেছি কমলার খোসা শুকিয়ে রাখতেন। তা পরে আন্দাজমতো নিয়ে মুশুর ডাল ও দুধ দিয়ে বেটে মুখে ঘাড়ে মাখতেন। কমলার খোসার গন্ধে শীত জমে উঠতো। আম্মা কখনোই লিপস্টিক ব্লাশঅন মাখতেন না কিন্তু পণ্ডস বা টিব্বত পাউডার ঘাড়ে গলায় মাখতেন এবং তা পুরোপুরি মুছতেন না। হাতে বানানো কাজল এমন ভাবে চোখে আঙ্গুল দিয়ে আঁকতেন আজকালকার পার্লারে তা চিন্তাও করতে পারবেন না। আর চুল পেছনে টেনে নিয়ে উঁচু বড় খোঁপা করে নেট কাঁটা দিয়ে আটকে নিতেন। তারপর রুপার কাঁটায় খোঁপার চেহারা বদলে যেতো। বেশির ভাগ সময়ই আমার আববা আম্মাকে এমন সিনেমার নায়িকার মত করে অপূর্ব খোঁপা বেঁধে দিতেন। কত কিছু দেখার সৌভাগ্যই না আললাহ আমাকে দিলেন। 

এরপর এমন এক সময় আসলো আমমা আর সাজতেই চাইতেন না। কিন্তু আব্বার বিশেষ পছন্দে কাজল দিতেন। সবসময়ই আমার মাকে আমার কাছে একটি ফুটন্ত গোলাপ মনে হতো। যে গোলাপী ফিনফিনে আসল গোলাপ আমি দেখেছিলাম আমার দাদাবাড়ির দখিনা গোলাপ ঝাড়ে! আমরা তিন বোনের কেউই আমার মায়ের সৌন্দর্য পাইনি তবে পেয়েছি রূপ সৌন্দর্য যৌবন কে অনায়াসে হেলাফেলা এবং অবহেলা করবার দুর্দান্ত সাহস। আমার বড় বোন মেঝো বোন কখনোই রূপ সৌন্দর্য কাপড় জামা নিয়ে ভাবেন না। আমি যেহেতু একজন শিল্পী সেহেতু কিছু সাজসজ্জা আমাকে করতেই হয় সেহেতু আমি তাদের চাইতে একটু আলাদা এবং অসহায়। সাজতে আমার একদম ই ভালো লাগে না। জীবনে কখনোই সৌন্দর্য সেবা নিতে পার্লার এ যাওয়ার দরকার মনে করিনি। মেয়ের পাল্লায় পড়ে একবার দুবার আমাকে যেতে হয়েছে বটে কিন্তু কাউকেই আমার এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ মনে হয়নি। আমাকে একবার এক নামকরা পার্লার মালিক তার নিজের আয়োজিত একটা ভিজুয়্যাল ইন্টার্ভিউ তে আমাকে অতিথি হিসেবে নিলেন। ইন্টার্ভিউ এর এক জায়গায় আমাকে জিজ্ঞাসা করা হল রূপচর্চার জন্য আমি কি করি কি ভাবি, আমি বললাম তেমন কিছুই না, এই একটু কমলার খোসা লেবু দুধ তেল, এই মা খালারা যা মাখতেন আরকি! প্রশ্নকর্তা অবাক! পার্লার বেইসড ইন্টার্ভিউতে এ কোন গেস্ট! উনি আরো জিজ্ঞাসা করলেন মেনিকিউর পেডিকিউর? আমি হা করে ইন্টার্ভিউ মাটি করলাম। কারণ ওই শব্দদুটির সঙ্গে তখনই আমার পরিচয় হল। ইন্টার্ভিউ সেখানেই শেষ! হাহাহাহাহা। আমার মনে হয় এজীবনে গান গাইতে আমি কোন কষ্ট পাইনি যতটুকু কষ্ট পেয়েছি তা এই অনাকাঙ্ক্ষিত মেকআপ এ! মাঝেমধ্যেই মনে হয় চুনকালি না মেখেই একদিন মঞ্চে দাঁড়িয়ে যাবো। সাজসজ্জা কখনোই নারীর কাছে বিরক্তিকর ব্যাপার ছিলনা। আমিও তার বাইরে না। কিন্তু এই যে একজন মানুষের আসল চেহারা প্যানকেকে সাদা করে আর আগের চেহারা না ফুটিয়ে যা খুশী একে দেয়া, এইটা কি সাজসজ্জা! আলগা পাপড়ি, আলগা লেন্স. আলগা চুল আরও কতকিছু আলগা লাগিয়ে সবাইকে এক কাতারে ফেলে দেয় যে সাজসজ্জা, তাকে আর যাই হোক মেধা সম্পন্ন মানুষ পছন্দ করতে পারেনা। যে সাজ আমার আমিকে ডুবিয়ে অন্য কাউকে ফুটিয়ে তোলে সে সাজ আমার না। আগের দিনের বিয়ের ছবিতে বৌয়ের যে লজ্জামাখা জরির ঝালরের ঘোমটা তা কি এই আলগা সাজ সম্বলিত বৌদের কাছাকাছি পাবো? আমি বিশ্বাস করি একজন মানুষের রূপ খোলে তার ভেতরের জ্ঞান প্রজ্ঞা মানবিকতা প্রচ্ছন্ন হাসিতে। মনের সৌন্দর্য মুখে ভাসিয়ে তোলাই আসল সাজসজ্জা। চুনকালি মাখলে তা তুলতে বড়ই কষ্ট কিন্তু ভেতরের সৌন্দর্য ফুটিয়ে নিজেকে সাজালে বাইরে থেকে ঘরে এসে সেগুলো খুলে ফেলতে হয়না। আমি তো আর সাপ না যে ঘরে এসে খোসল ছাড়বো! আসুন মা বোনেরা, আমরা আমাদের বাবা ভাই স্বামীর মত চুনকালি ছাড়াও বাইরে বেরুনোর সাহস অর্জন করি। এবং আমাদের ভেতরের অপরূপ সুন্দর গোলাপ ফুটিয়ে তুলি। (এর বাইরে আমিও নই কিন্তু কারণ অল্পবিস্তর চুনকালি আমাকেও মাখতে হয়) হাহাহাহাহা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *